সাদামাটা এক সাধক পুরুষ
চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কাগজের বুকে কলম
চলছেনা। থেমে থেমে আসছে। সত্যিই বিশ্বাস করতে পারছিনা। মনে হচ্ছে দুঃ¯^প্নের
ঘোরে আছি। খবরটা বোধ হয় মিথ্যা না! দরজার ওপাশে তিনি, এপাশে
আমরা কয়েক হাত দূরত্বে আমাদের অবস্থান। তবুও কেমন জানি মনে হচ্ছে কয়েক জনম দূরে
তার অবস্থান। ছোট-বড় সকলের চোখে পানি। ভাষা নেই মুখে, আনমনে
তাকাচ্ছিলেন একে অপরের দিকে। তাকিয়ে আছেন তার দিকে। কিন্তু তিনি যেন আমাদের না
দেখার বায়না ধরেছেন। আর কোনদিন আমাদের দেখবেন না। ডাকবেন না আর আদর করে। দরজার
ওপাশ থেকে উন্মোচিত হবে না আর সেই নূরানী চেহারা। মসজিদের নামাযের স্থানটি আর
কাউকে পাবে না তার মত করে। হুইল চেয়ারটি সঙ্গী হারা হবে। ভাবতেই বেদনায় ভিতরটা
মোচড় দিয়ে ওঠে। সন্ধ্যা ঘনালো। জীবনের পাতা থেকে আরো একটি দিন বিদায় নিলো। ইমাম
সাহেব সালাম ফিরালেন। মাগরিবের নামাজ আদায় শেষ হলো। আমাদের কেউ সুন্নতের নিয়ত
করেছে,
কেউ
করবে। ঠিক এমন সময় কতক তালেবে ইলম ভীড় জমাল শায়খের কামরার সামনে। সবার চেহারায়
প্রশ্নের ছাপ ফুটে আছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান সকলে। পরক্ষণে গুঞ্জন উঠল “আর
নেই”
বুঝতে
আর দেরী হলো না কে নেই? এই নশ্বর পৃথিবীকে আলোকিত করে না ফেরার
দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। হাদীস শাস্ত্রের এক নক্ষত্র পুরুষ, ঐতিহ্যবাহী
দারুল উলূম মাদানীনগর মাদ্রাসার শায়খে আউয়াল মাওলানা যাকারিয়া রহ.। ব্যক্তিজীবনে
তিনি ছিলেন খ্যাতির আড়ালে পড়ে থাকা একজন নিষ্ঠাবান ইলমী সৈনিক। তার সুধাময়ী
পাঠদানে পরিতৃপ্ত হতেন হাজারো ইলম পিপাসু তালিবে ইলম। তাঁর দৃষ্টি ও চিন্তা ছিল ¯^তন্ত্র
সুদূরপ্রসারী, তিনি ছিলেন পূর্ণ সততা, উদারতা
ও প্রজ্ঞার অধিকারী, তার সিদ্ধান্ত হতো যথাযথ, পরামর্শ
হতো ফলপ্রসূ, নববী আদর্শের এক সাধক পুরুষ। অনড়
ব্যক্তিত্ব ও নিরহংকারী মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জীবন-যাপনে
ছিলেন অতি সাদা-সিধে। এতেই ¯^াচ্ছন্দ্যবোধ করতেন
তিনি। সাদামাটা শব্দটি মনে আসলে প্রথমে যার ছবি ভেসে ওঠত তিনি শায়খুল হাদীস
যাকারিয়া রহ.।
একজন শায়খের জীবন এত সাদামাটা হতে পারে তা শায়েখকে না দেখলে বুঝেই
আসবে না। বহুবার খুব কাছ থেকে শায়খকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কেমন জানি এক অদ্ভুদ
মায়া ভর করে আছে সেই স্মৃতিগুলো। জিক্র যে কত মধুর হয় তা শায়খের কণ্ঠে শুনলে বুঝা
যেত। আশেক-মাশুক এর সম্পর্ক যে কত গভীর হয় তা অনুমান করা যেত শায়েখকে জিকিররত
অবস্থায় দেখলে। এই মহান ব্যক্তিটিকে কদর না করার অনুশোচনা কম-বেশ সবাইকে পলে পলে
যন্ত্রণা দিয়ে যাবে। হুজুরের খাদেম মাকসুদ ভাই। অত্যন্ত সরলমনা মানুষ তাকাল্লুফের
ফর্মালিন থেকে মুক্ত স্পষ্টভাষী। একরাজ্য আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম মাকসুদ
ভাইয়ের কাছে শায়েখ সম্পর্কে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুই শোনালেন মাকসুদ
ভাই। কখনো হেসেছি, কখনো কেঁদেছি, আর
কখনো বা অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছি। এক পর্যায়ে শায়েখের চলে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বের
একটি কথা শোনালেন। শায়খ্ আমাকে বলেছিলেন “মাকছুদ!
রাসূল সা. ৬৩ বছরে ইন্তেকাল করেছিলেন, আমারও
এ বছর ৬৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই কথাটি বলতে গিয়ে জগদ্দল পাথর যেন চেপে বসলো মাকছুদ
ভায়ের বুকে। কথা বলতে বলতে আঁখি যুগল ছলছল করে উঠলো সবার। মাকসুদ ভাইয়ের গাল বেয়ে
অশ্রæ
গড়াল, তার
রেখে যাওয়া অগণিত শিষ্য ইলমী আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় ভা¯^র
হয়ে আছেন। পরম করুণাময় আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের উচ্চাসন দান করুন। এবং তার রেখে
যাওয়া প্রজন্মকে আরো ব্যাপকভাবে দ্বীনের খেদমত করার তাওফীক দিন। আমীন
No comments